পটিয়া প্রতিনিধি :: কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহাকে যেদিন পুলিশ হত্যা করে, সেদিনই অনেকটা নিরবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয় আরও তিন যুবককে। ঘটনাস্থল কক্সবাজারেরই আরেক থানা চকরিয়া। পটিয়া থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া এক প্রবাসী ও দিনমজুরের সঙ্গে চকরিয়ার এক যুবককেও একইসঙ্গে সেদিন ‘হত্যা’ করা হয়।
চকরিয়া থানা পুলিশ সেদিনই সংবাদমাধ্যমে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানিয়েছিল— ‘কক্সবাজারের চকরিয়ায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৩ মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওসিসহ ৪ পুলিশ সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ হাজার পিস ইয়াবা, অস্ত্র ও গুলি। শুক্রবার (৩১ জুলাই) ভোরে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া বানিয়ারছড়া আমতলী গর্জন বাগান পাহাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।’
ঘটনাটি ধামাচাপাই পড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু মেজর (অব.) সিনহা হত্যার ঘটনার পর স্বজনরা আর চুপ থাকতে পারেননি। এখন জানা যাচ্ছে, পরিকল্পিতভাবেই ওই প্রবাসী ও দিনমজুরকে পটিয়ার বাসা থেকে ধরে চকরিয়ায় নিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে চকরিয়া থানা পুলিশ। নিহতের স্বজন ও স্থানীয়দের দাবি, তারা কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। পুলিশকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের। ঘর থেকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার দেওয়ার আগে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল পুলিশ—এমন অভিযোগও উঠেছে সুনির্দিষ্টভাবে।
নিহতদের স্বজনরা জানান, পুলিশের দাবি করা টাকা দিতে না পারায় নিরপরাধ দুই যুবককে হত্যা করে ইয়াবা উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার তিনদিন আগে পটিয়া থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার পর পুলিশ রহস্যজনকভাবে তাদেরকে ‘অজ্ঞাত’ পরিচয়ে প্রচারণা চালায়।
জানা গেছে, গত ২৯ জুলাই ভোর ৬টায় পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউপির ভাইয়ের দীঘির পাড় তালতলা এলাকার নিজ বাসা থেকে আব্দুল আজিজের পুত্র মোহাম্মদ জাফর এবং পটিয়া সদরের পাইকপাড়া এলাকার আবুল কাশেমের পুত্র মোহাম্মদ হাসানকে (৩৭) আটক করে চকরিয়া থানা পুলিশ। পরে জাফরের পরিবারের সদস্যদের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ৩১ জুলাই ভোর রাতে কথিত ইয়াবা উদ্ধারের অভিযানে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছে দাবি করে ৪৪ হাজার ইয়াবা ও ৩০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করার কথা প্রচার করে পুলিশ। এমনকি এ সময় চকরিয়া থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমান, হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম, কনস্টেবল সাজ্জাদ হোসেন ও মো. সবুজ ‘আহত’ হন বলে জানানো হয়েছিল।
নিহত মোহাম্মদ জাফর ১৮ বছর ধরে প্রবাসে ছিলেন। তার বাড়ি পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নে। চলতি বছরের ১২ মার্চ ওমানপ্রবাসী জাফর দেশে আসেন। লকডাউনের আগে দেশে আসলে করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আর বিদেশে যেতে পারেননি। অপরজন মোহাম্মদ হাসান পেশায় রিক্সাচালক। রিক্সা চালিয়ে তার সংসার চলে। হাসানের আরেক ভাই দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন।
জাফরের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, ‘আমার স্বামী কখনো মাদক ইয়াবার সাথে জড়িত ছিল না। তিনি প্রবাসে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। তিনি খারাপ— এলাকায় কেউ এমন প্রমাণ দিতে পারবে না। আমি বিয়ষটি তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হাসানের বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর শফিউল আলম বলেন, ‘হাসান একজন দিনমজুর রিক্সা চালক। সে মাদক ইয়াবার সাথে কখনো জড়িত ছিল না।’
কচুয়াই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, ‘জাফর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দুরের কথা একটি সাধারণ ডায়েরিও ছিল না, তাকে অন্যায়ভাবে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের (দক্ষিণ) পরিদর্শক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জাফর ও হাসান নামে যে দুজনকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্যের কোন মামলা আছে এই ধরনের তথ্য আমাদের হাতে নেই।’
চকরিয়ায় কথিত অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আমিনুল ইসলামের কাছে তিনদিন আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা নিহত হওয়ার পর অজ্ঞাত পরিচয়ে কেন প্রচার করা হল—এমন প্রশ্ন রাখা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে চকরিয়া থানার ওসিই ভাল বলতে পারবেন। এর পরপরই ‘জরুরি মিটিং’ আছে বলে লাইন কেটে দেন তিনি। এ বিষয়ে চকরিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ হাবিবুর রহমানের সাথে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি।
এদিকে পুলিশের দাবিকৃত ৫০ লাখ টাকা দিতে না পারায় প্রবাসীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ওসিসহ দুই পুলিশের বিরুদ্ধে পটিয়া আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। রোববার (১৬ আগস্ট) পটিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ভিকটিমের মামা মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদ শফি মামলাটি দায়ের করেন।
আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আসামিরা হলেন চকরিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম।
পাঠকের মতামত: